রেলে সাধারণত এমন হয় না আজকাল । বাংলাদেশে ভিড় বলতেই চোখে ভাসে দরজার রড ধরে ঝুলছে মানুষের পর মানুষ । শুক্রবার বলে কিনা জানিনা , আজ এমনটি নেই । প্ল্যাটফর্মে অল্পকিছু লোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটাছুটি করছে । ট্রেনের হুইসাল শুনা যাচ্ছে । এখনি এলো বলে । এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস কিশোরগঞ্জ থেকে ছেড়ে এসে প্রথম যাত্রা বিরতি গচিহাটা । ছোট্ট স্টেশন ।
দেখতে দেখতে ঝক ঝকা ঝক ট্রেন এসে দাঁড়াল প্ল্যাটফর্মে । রাজু যেখানে দাঁড়িয়েছিল তার সোজাসুজি একটা বগী এসে থামলো । সে ডানে বামে তাকিয়ে সোজা ট্রেনের কামরায় প্রবেশ করলো । প্রথম শেণির কামরা । লোকজন হালকা । সিট খালি দেখে একটিতে আসন গেড়ে বসলো সে । হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন । এবার ট্রেন বাবাজী আপন গতিতে চলতে থাকুক।
ট্রেনে উঠা অবধি রাজু কেমন যেন আনমনা ছিলো । এর একটি কারণও আছে হয়তো ! সে স্ট্যান্ডিং টিকিট করেছে অথচ প্রথম শ্রেণির কামরায় উঠে দিব্যি বসে আছে । মনে মনে ভাবছে টিটিসি আসলে কি জবাব দেবে ?
এমন সব ভাবনায় সে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাল । একজোড়া চোখ তার দিকেই চেয়ে আছে । হঠাত অবলীলায় চোখে চোখ পড়ে গেলো দু'জনার । ক্ষণকাল মাত্র । দু'জনেই যেন লজ্জা পেল । পলকে চোখ নামিয়ে রাখলো দু'জনেই ।
রাজু মনে মনে ভাবলো, এমন সুন্দরী মেয়ে জীবনে দেখিনি ! কি মায়াময় চেহারা ! চোখের গভীরে যেন সাত সমুদ্র ! আবার তাকাতে সাহস হচ্ছে না ।
অরণী কিশোরগঞ্জ থেকে ট্রেনে উঠেছে । বাজিতপুর যাবে । জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল । তার বাবা খুব অসুস্থ । হাসপাতালে ভর্তি আছে বেশ কিছুদিন । সে আর তার ভাই শিমুল পর্যায়ক্রমে হাসপাতালে বাবাকে সময় দেয় । বাবাটা কেন যে এত ভাল ? বাবার জন্য তার মনটা ভারী হয়ে থাকে সবসময় । আচ্ছা বাবা যদি মারা যান ! একি ভাবছে অরণী ! নানা বাবা মরবে কেন ? বাবা বেঁচে থাকুক চিরকাল - পৃথিবীর সব মেয়েরাই হয়তো এমনি ভাবে বাবার জন্য ।
রাজু যখন ট্রেনে উঠে তখন যাত্রিদের উঠানামা দেখছিল অরণী । তার মাঝে হঠাত চোখে পড়লো একটা হেন্ডসাম ছেলে । কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই । যে কেউ এদিক দিয়ে আসছে, তাকে বাঁকা চোখে দেখে নিচ্ছে । সব মেয়েরাই যেন এ ব্যাপারটি কেমন করে আঁচ করতে পারে । অথচ এ ছেলেটির তার দিকে চোখ পড়লো না পর্যন্ত । অদ্ভূত ছেলেতোরে বাবা ! একদম ঝটাং ঝটাং এসে তার অপজিটের সিটে বসে পড়লো । অথচ দেখলো না তার সামনে একটি সুন্দরী মেয়ে বসে আছে ।
এরই মধ্যে আচমকা দৃষ্টি বিনিময় । লোকে যে বলে চোখে জাদু আছে, এরই উপযুক্ত উপমা যেন । অতঃপর রাজুর দৃষ্টি জানালাগলে বাইরে । বাইরে সীমাহীন সবুজ । সবুজেরা অবুঝের মত নীলিমায় মিশে গেছে দূরে বহু দূরে । আমগাছ, জামগাছ দৌড়াচ্ছে ট্রেনের সাথে সাথে । আহা কী অদ্ভূত সুন্দর !
অরণী দেখে বাইরে নীলাকাশ । নীচে থোকা থোকা সোনালী ধান । পাশেই গরু ছাগলের বাতান । রাখলেরা ডাংগুলি খেলছে মনের সুখে । ঝিলের জলে ডুবসাঁতারে ব্যস্ত একঝাক পাতিহাঁস ।
দু'জন দু'জনার মতো দেখে প্রকৃতির শ্যামলিমা । রাজু ভাবে, আর একবার যদি দেখা যেতো ঐ সুন্দর মুখ , মায়াবী ডাগর দু'টি চোখ ! সাহস ও লজ্জা বাদ সাধলো রাজুর । স্কুলে শিখা নীতিবাক্য গুলো বার বার মনে হতে লাগলো শুধু ।
অরুণী ভাবছে, আহা তুমি কথা বলছো না কেন ? মেয়েরা আগে কথা বলে বুঝি ? কি বোকা ছেলেরে বাবা ! কিছুই বুঝে না ? ও মেষ হবে ভাল ।
মনের কথা মনে রইলো দু'জনের । ট্রেন আপন গতিতে চলতে থাকলো । দু'জনেই স্থির । ভেতরে ভেতরে অস্থির । অরণী হ্যান্ডব্যাগে হাত রাখলো । একটি কলম এলো হাতে । বাম হাত চোখের সামনে মেলে ধরলো । ডান হাতে ক্যাপ -বন্ধ কলম । লিখা চলল হাতের খাতায় এলোমেলো । বোকার কাব্য । বোকা ছেলেরে কে ভালবাসেরে ! আমি নেই এসবে ।
ট্রেন চলছে ঝক ঝকা ঝক । শরীর মন দোল খাচ্ছে রাজুর । সামনে বসা মেয়েটির চোখ দেখতে ইচ্ছে করছে বার বার । কিন্তু সে বাইরে চেয়ে আছে তো আছেই । আনমনে বলছে, আমি যে তার কথা ভাবছি এত, সে কি ভাবছে আমারে ? আহা ! এমন যদি হতো !
ফেরিওয়ালা হেকে যাচ্ছে , চানাচুর -র -র , কিসমত আলীর চানাচুর র- র । গাড়িত খাইলে বাড়িত মজা , বাড়িত খাইলে গাড়িত মজা । নিজে খাইলে পাঁচ টাকা । বাড়ির লাইগ্যা দশ টাকা । শ্বশুরবাড়ির লাইগ্যা বিশ টাকা । চানাচুর র- র ।
ঘার ফিরাল অরণী । ফিরে তাকাল রাজু । আবার চোখে পড়লো চোখ । দু'জনে তাকিয়ে আছে অপলক । দু'জনেই নিজেকে খুঁজছে যেন অন্যের চোখে । আহা ভাষা যেন শিশুপাঠ আদর্শ লিপি । এভাবে কতক্ষণ কে জানে ? নির্বাক দু'টি হৃদয় । মুখে ভাষা নেই । চোখে কবির অমর কাব্য ।
পাশেই বসেছিল এক দম্পতি । সঙ্গে একটি ৭/ ৮ বছরের শিশু । সে খুব মজা পাচ্ছিল । মাকে শুধাল - মা, ওরা দুজন চোখাচোখি করছে কেন?
চমকে উঠলো রাজু , চমকে উঠলো অরণী ! লজ্জায় শাদা হয়ে গেল দুটি মুখ । মা শিশুটিকে তিরস্কার করল , ছিঃ এমন করে কথা বলে বাবা ?
চানাচুরওয়ালা দীর্ঘশ্বাস ফেললো , অস্ফুটে বললো, আহা এমন দিন আমাদেরও ছিলো ! মুখে হাসি ফুটিয়ে অরণীর সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো , আপুমনি আপনার জন্য এক প্যাকেট আর ভাইয়ার জন্য এক প্যাকেট ।
অরণী ব্যাস্ত হয়ে বললো, না না আমি চানাচুর পছন্দ করি না ।
চানাচুরোয়ালা আবার একগাল হেসে বললো , আপুমনি এইটা আমার পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য উপহার । এটার দাম দিতে হবে না ।
রাজু অরণি পরস্পর চাওয়াচাওয়ি করলো ।এই ফাঁকে কিসমত কোথায় যেন হারিয়ে গেল ।
চানাচুরওয়ালা চলে গেলে আবার দু'জনের চার চক্ষুর মিলন হোল । দুজনেরই মুখ লজ্জায় লাল হলো যেন সন্ধ্যার লালীমা ।
অতঃপর দু'জনেই চোখ নিচু করে বসে রইলো কিছুক্ষণ । মনের মধ্যে হয়তো রাসায়নিক বিক্রিয়া হচ্ছে নিরন্তর ।
রাজু একটা ম্যাগাজিন হাতে নিল । মুখের সামনে মেলে ধরলো । ঢেকে গেল মুখমন্ডল । আশ্চর্য ম্যগাজিনের পাতায় ভেসে উঠলো সেই মুখ , সেই চোখ ।
অরণী দেখতে পাচ্ছে না রাজুকে । অই মুখটা দেখার জন্য মন কেমন যেন চঞ্চল জয়ে উঠেছে । রাজুর মুখ থেকে ম্যাগাজিন নামছে না । অসহ্য লাগছে অরণীর । সেও ব্যাগ থেকে বই বের করে মুখের সামনে মেলে ধরলো । মনে মনে বললো, এবার বুঝ মজা ? কথা নেই , পরিচয় নেই , এ কেমন অভিমান ?
কিছুক্ষণের মধ্যে ধরণ পাল্টে গেল । একজন ম্যাগাজিন নামিয়ে অন্যজনকে দেখার চেষ্টা করলো - না, মুখ ঢাকা আছে । অপরজনও চোখ থেকে বই সরিয়ে উঁকি দিল । কিন্তু না, ম্যাগাজিনে ঢাকা আছে ঐ মুখ । সেইসাথে একটা যন্ত্রণাও যেন উঁকি দেয় মনের কোণে ।
এভাবে লুকোচুরি খেলা চলতে থাকে কিছুক্ষণ । জগত সংসারে এ কিসের মায়া ?
এবার ঈশ্বর সহায়তা করলো দুজনকেই যেন । লুকোচুরিতে দু'জনেই উঁকি দিল একসাথে । আবার একরাশ লজ্জা এসে ভর করলো ওদের চোখে মুখে । মনে হলো দুজনেরই চোখজোড়া যেন অমর কাব্য গাঁথা । পাঠ করছে একে অপরের মনের গহীন কথা ।
এরই মাঝে গাড়ি কখন যে হুইসাল বাজিয়ে বাজিতপুর স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে , টেরই পায়নি কেউ । পাশের শিশুটি অরণীকে নাড়া দিয়ে বললো, আন্টি আমরা চলে যাচ্ছি, বা-ই -ই ।
আরণীর চমক ভাঙল । এখানে যে তারও নামতে হবে । বাবা শুয়ে আছেন হাসপাতালের বেডে । ঝটপট নামতে চাইলো সে ।শেষবারের মতো আড়চোখে চাইলো রাজুর দিকে । রাজুও বোকার মত চেয়ে আছে তার দিকে । ইচ্ছে করলো জিজ্ঞেস করে নাম পরিচয় । পারলো না । বোধে এসে ঠেকল যেন ।
অরণী ধীর পদে নেমে এলো ফ্লাটফরমে । মানুষের ট্রেনে উঠানামা চলছে । পৃথিবী হাঁটছে আপন গতিতে । গার্ড সবুজ পতাকা নেড়ে বাঁশি বাজাল । চলতে শুরু করলো ট্রেন । ঐতো দেখা যায় , ছেলেটি তারই দিকে তাকিয়ে আছে নিবিষ্ট মনে ।
অরণী ট্রেনের চলে যাওয়া দেখছে তো দেখছেই । হঠাত অবলীলায় তার হাত উঠে এলো । সে রাজুর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানাতে লাগলো অনবরত । ততক্ষণে রাজুও হাত নেড়ে সাড়া দিল ট্রেন থেকে ।
ট্রেন ছোট হয়ে আসছে । ছোট থেকে ছোট । এখনি অদৃশ্য হয়ে যাবে দিগন্তে । অরণীর মনে হলো দেখা যাচ্ছে ঐ মুখ । ঐ দু'টি চোখ যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে ।
অরণী মনের অজান্তে অস্ফুটে বলে উঠলো , তুমি যেও না , তুমি যেও না ।
ট্রেন তবু ছুটে চলেছে । ট্রেন তবু চলে যায় ----- ।
১৬ জানুয়ারী - ২০১২
গল্প/কবিতা:
১৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪